স্বাদের ঐতিহ্যে বাঙালি

স্বাদের ঐতিহ্যে বাঙালি

শুরুতেই একটা লম্বা উদ্ধৃতি, এবং সেটা অবশ্যই সৈয়দ সাহেবের মানে সৈয়দ মুজতবা আলীর। কলোনিয়াল প্রভুদের খাদ্যাভ্যাসের সাথে নেটিভদের পেটপুজোর তুলনা করে ভোজনরসিক বাঙালির প্রামাণ্য নিদর্শন মুজতবা আলী প্রথম লিখেছিলেন-বাঙালির রসনা নিয়ে, জলে ডাঙায়।

বলেছিলেন-‘আমরা তেতো, নোনা, ঝাল, টক, মিষ্টি—এই পাঁচ রস দিয়ে ভোজন সমাপন করি। ইংরেজ খায় মিষ্টি আর নোনা, ঝাল সামান্য, টক তার চেয়েও কম এবং তেতো জিনিস যে খাওয়া যায়, ইংরেজের সেটা জানা নেই। তাই ইংরেজি রান্না আমাদের কাছে ভোঁতা ও বিস্বাদ বলে মনে হয়। অবশ্য ইংরেজ ভালো কেক-পেস্ট্রি-পুডিং বানাতে জানে—তাও সে শিখেছে ইতালিয়ানদের কাছ থেকে এবং একথাও বলব, আমাদের সন্দেশ-রসগোল্লার তুলনায় এসব জিনিস এমন কী, যে নাম শুনে মূর্ছা যাব।’

আরে ছেড়ে দিন রসগোল্লার কথা ও কাহিনী। রসগোল্লাতো ক’দিনের শিশু। চর্যাপদ দেখুন মশাই। প্রাকৃত বাঙালির মনমতো খাওয়া হলো কলাপাতায় ‘ওগগরা ভতা গাইক ভিত্তা’ মানে গাওয়া ঘি, দুধ আর সরু চালের পরমান্ন।

এবারে চলুন মধ্যযুগে, যখন ব্যাধ কালকেতুর শিকারের মাংসের বিক্রিবাট্টা হাটে হয়েছে হটকেকের মতো। বরিশালের বিজয়গুপ্ত মনসামঙ্গলে কাব্যি করে লিখেছেন দিস্তে দিস্তে রেসিপি। তার মেন্যু শুরু হয় নিরামিষে, শেষ হয় নাভিশ্বাসে।

‘রান্ধি নিরামিষ ব্যঞ্জন হলো হরষিত।

মেস্যর ব্যঞ্জন রান্ধে হয়ে সচকিত

মৎস্য মাংস কুটিয়া থুইল ভাগ ভাগ।

রোহিত মৎস্য দিয়া রান্ধে কলকাতার আগ

মাগুর মৎস্য দিয়া রান্ধে গিমা গাচ গাচ

ঝাঁঝ কটু তৈলে রান্ধে খরসুল মাছ

ভিতরে মরিচ-গুঁড়া বাহিরে জড়ায় সূত।

তৈলে পাক করি রান্ধে চিঙড়ির মাথা

ভাজিল রোহিত আর চিতলের কোল।’

বাঙালির এই যে মৎস্যপ্রেম তাহার জন্ম কোথা হতে নির্ণয় ন জানি! যদিও শুধু সাহিত্যেই মাছ নিয়ে বাঙালির খাই খাইয়ের কমতি নাই। ময়মনসিংহের দ্বিজ বংশীদাস (ইনি বিশিষ্ট নারী কবি চন্দ্রাবতীর পিতা) তার ‘মনসামঙ্গল’-এ লিখেছেন,

‘বড় বড় কই মৎস্য, ঘন ঘন আঞ্জি

জিরা লঙ্গ মাখিয়া তুলিল তৈলে ভাজি।

কাতলের কোল ভাজে, মাগুরের চাকি।

চিতলের কোল ভাজে রসবাস মাখি

ইলিশ তলিত করে, বাচা ও ভাঙ্গনা।

শউলের খণ্ড ভাজে আর শউল পোনা

এ পর্যায়ে বাঙালি আর ভোজন রসিক নয় পরিণত হয় ভোজন শিল্পীতে। বুদ্ধদেব বসুর মতো আধুনিকতম বাঙালি কবিও তাই লেখেন ইলিশ নিয়ে আস্ত এক কবিতা-

‘রাত্রি শেষে গোয়ালন্দে অন্ধ কালো মালগাড়ি ভরে

জলের উজ্জ্বল শষ্য, রাশি-রাশি ইলিশের শব,

নদীর নিবিড়তম উল্লাসে মৃত্যুর পাহাড়।

তারপর কলকাতার বিবর্ণ সকালে ঘরে ঘরে

ইলিশ ভাজার গন্ধ; কেরানীর গিন্নির ভাঁড়ার

সরস সর্ষের ঝাঁজে। এলো বর্ষা, ইলিশ -উৎসব।‘

বর্ষায় অনার্য দেবতা শিবও তাই অন্নপূর্ণার কাছে খেতে চান ডাবের জল দিয়ে রান্না মুগ ডালের খিচুড়ি। সেকারণেই রবীন্দ্রনাথের ছেলেভোলানো কবিতায় পিপড়ার কেঁদে যাওয়া শেষ পাতে সন্দেশ আর কদলীর ঝনাৎ ঝনাৎ পায়েল বাজে বড় মধুর স্বরে। বিভূতিভূষণের হাজারী ঠাকুর রাঁধেন ট্রেনের বাবুদের জন্য সেই অসম্ভব শিল্প, মাংসের ঝোল যা কখনো হয়না জঠুর।

বাঙালির রসনায় কাবাব-মেওয়ার ছড়াছড়ি হয়েছে আস্তে ধীরে। বঙ্গে সুফি প্রভাবের সাথে সঙ্গত করে এসেছে পনির- পরোটা, এসেছে কালোয়াতি গান সাথে শিক আর শামি কাবাব। ক্যাথলিক ধর্ম আর মশলার সওদা করতে আসা পর্তুগিজরা এনেছিল আলু, ফুলকপি। সকলের কাছ থেকেই দু’হাতে নিয়েছে বাঙালি, অন্তত রসনার ক্ষেত্রে সে পুরোদস্তুর শংকর। খাওয়ার ব্যাপারে বাঙালি ‘না-গ্রহণ না-বর্জন’ নীতিতে সহনশীল। বাঙালি বাড়ির নিমন্ত্রণে প্রথমে আদি-অকৃত্রিম শাক, তারপর আসবে মোগলাই পোলাও, কোর্মা, কাবাব এবং শেষে আসবে ইংরেজি-বাঙালি পর্বে চপ-কাটলেট থেকে আইসক্রিম পর্যন্ত। গোপাল হালদার লিখেছেন- ‘নিমন্ত্রণ তো নয়, এ বাঙালির ইতিহাস… বাঙালির নিমন্ত্রণে আজ নিমন্ত্রিত হয় বাঙালি অতিথির তিন জন্মের তিন সত্তা। সেই আদি জন্মের গেঁয়ো বাঙালি সত্তা, তার মধ্যজন্মের আধা-মুসলমানি সত্তা, আর তার ইংরেজি আমলের আধা-ঔপনিবেশিক সত্তা। কিন্তু সত্তা যত বিচিত্র হোক, হায়, উদর মাত্র একটি।’

সৈয়দ মুজতবা আলী একবার ‘বাঙালী মেনু’ তৈরি করেছিলেন। মহান এই কার্য সমাধা করতে গিয়ে তিনি লিখেছিলেন, ‘মাছের সঙ্গে সর্ষে, যেন রবীন্দ্রসংগীতে কথার সঙ্গে সুরের মিলন।’ বহুদেশ ভ্রমণের সময় তাঁর প্রাণ কেঁদেছিল শুধুমাত্র—চারটি আতপ চাল, উচ্ছে ভাজা, সোনামুগের ডাল, পটল ভাজা আর মাছের ঝোলের জন্য।

আর মিষ্টি!! বাঙালির সুসংবাদে মিষ্টি, আতিথ্যে মিষ্টি, ভদ্রতায় মিষ্টি, বিয়েশাদি- এমনকি কুলখানিতেও মিষ্টি।

ফরাসিরা বলেছিল, ‘এপাতাঁ!’

জর্মনরা, ‘ক্লর্কে!’

ইতালিয়ানরা, ব্রাভো!’

স্প্যানিশরা, ‘দেলিচজো, দেলিচজো।’

আরবরা, ‘ইয়া সালাম, ইয়া সালাম!’

বলুনতো কথা হচ্ছে কি নিয়ে? রসগোল্লা। বাঙালির অনন্য অনবদ্য অসামান্য এক সৃষ্টি। কমলালেবুর দেশের সৈয়দের ভাষায় লেখা সেই ঝান্ডুদাকে পাবেন কোথা আর কোথায় বা পাবেন টিনভর্তি রসগোল্লার হদিস?

সৈয়দ মুজতবা আলী একবার দুঃখ করে লিখেছিলেন- আপনার কোনো বিদেশি বন্ধু শহরে এলে তাকে আপনি কন্টিনেন্টাল থেকে চিনে ভাজা ভাত মানে ফ্রায়েড লাইস (চিনেদের ‘র’ নেই, আছে ‘ল’) পর্যন্ত খাওয়াতে পারবেন কিন্তু উচ্ছে ডাল খাওয়াতে পারবেন না।

এখন পারবেন, পাতুরি বাংলাদেশ সেটা নিশ্চিত করেছে, করবে। উদ্বোধনের শুরুতেই আগতদের জন্য পাতুরি বাংলাদেশের উদ্যোক্তা বেঙ্গল এক্সপ্রেস কর্তৃপক্ষ নিয়েছেন দারুণ এক উদ্যোগ, স্বাদে গন্ধে ষোলোআনা বাঙালিয়ানাকে অনুভব করার। পাতুরি বাংলাদেশের উদ্বোধনের উৎসবমুখরতায় অংশ নিন আপনিও। রঙের ছোঁয়া লাগুক আপনার চাঁদ বদনে, দেশি ঢংয়ে। ছোট্টবেলার মেলার মত করেই হয়ে যাক এক রাউন্ড বায়োস্কোপ, টিনের চৌকো বাক্স ঘুরিয়ে আনুক আপনাকে দিল্লির কুতুব মিনার থেকে লালবাগের কেল্লা। পুতুলের নাচের তালে, মাদল বাজুক আপনার প্রাণেও।

সুতরাং একচক্কর ঘুরে আসুন পাতুরি বাংলাদেশ থেকে। বনানীর ব্লক এইচের ১০/বি রাস্তার তিন নম্বর বাড়িতে। কি খাবেন সেথায়? বলুন কি খাবেন না!

ছবি সৌজন্যেঃ পাতুরি
তথ্য কৃতজ্ঞতা ঃ সৈয়দ মুজতবা আলী, শংকর ও মাহবুব আলম-এর বিভিন্ন রচনা

FEATURED POST

RECENT POST

Facebook
Twitter
Pinterest
Instagram
TripAdvisor